কিডনি পাথর (kidney Stone)
গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রায় ১০ জনের একজন মানুষ কিডনি পাথরের সমস্যায় ভুগে থাকেন।এবং নারীদের থেকে পুরুষদের কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
আমরা আমাদের প্রকৃতিতে যেসব পাথর দেখতে পাই সেগুলো মূলত বিভিন্ন খনিজ্লবনের সমন্বয়ে তৈরি।ঠিক তেমনই আমাদের দেহের ভেতরেও কিছু কিছু জায়গায় পাথর তৈরি হয়ে থাকে।
এসব পাথর আমাদের দেহের অভ্যন্তরের খনিজ লবণ দিয়ে তৈরি হয় ।উল্লেখযোগ্য কিছু স্থান হচ্ছে কিডনি,পিত্তথলি,অগ্নাশয় ইত্যাদিতে পাথর। এদের মধ্যে কিডনিতে পাথর নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন অনেকেই।
কিডনি পাথর কেন হয়(Causes of renal stone):
মূলত আমাদের শরীরের বর্জ্য পদার্থ থেকে পাথর তৈরি হয় যখন শরীরে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন দেখা দেয় তখন মূত্র ঘন থাকে এবং বিভিন্ন খনিজ্লবন যেমন ক্যালসিয়াম,অক্সালেট,ফসফেট,ইউরেট ইত্যাদি একসাথে জমাট বেঁধে পাথরের সৃষ্টি হয়।
কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর কিডনি পাথর তৈরিতে ভূমিকা পালন করে :
- অপরিমিত পানি পান ।
- স্থুলতা।
- অতিরিক্ত লবণ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।
- গরম আবহাওয়াতে দীর্ঘক্ষণ কাজ করা।
কিছু রোগের কারণে কিডনিতে পাথর হতে পারে।যেমন-
- প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির অতিকার্যকরিতা বা Hyperparathyroidism:এখানে শরীরে ক্যালসিয়াম এর পরিমাণ বেড়ে যায় ফলে স্টোন বাপাথর হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
- গাউট বা Hyperuricaemia:এখানে প্রস্রাবের সাথে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড বের হয়।এতে করে ইউরিক অ্যাসিড স্টোন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ।
- হাইপার অক্সালিউরিয়া(Hyperoxaliria):এই ক্ষেত্রে অক্সালিক এসিডের মেটাবলিসম এ সমস্যা দেখা দেয়।
- মিল্ক অ্যালকালি সিনড্রোম(Milk-Alkali Syndrome)
কিডনিতে পাথরের লক্ষণ (The symptoms of kidney stone):
অনেক ক্ষেত্রে পাথরের আকার ছোট (<.৫ সে.মি) থাকলে তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়না।তবে আকারে বড় হলে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে।যেমন –
- পেটের নিম্নভাগে,কুচকিতে তীব্র ব্যথা।যেসকল স্টোন এর সারফেস রুক্ষ যেমন অক্সালেট স্টোন এরা মূত্রনালীতে বার বার ইরিটেট করে যার ফল স্বরূপ ব্যথা হয়।
- প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া।স্টোন দ্বারা মূত্রনালির প্রাচীর ক্ষতগ্রস্থ হলে প্রস্রাবের সাথে রক্ত যায়।
- কাপুনি দিয়ে জ্বর আসা
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
- প্রস্রাবে জ্বালা
এছাড়াও পাথর মূত্রনালীতে আটকে গেলে মূত্রপ্রবাহ বন্ধ হয়ে কিডনি ফুলে যেতে পারে যাকে বলা হয় হাইড্রনেফ্রসিস(Hydronephrosis)
কিডনিতে পাথরের প্রকারভেদ(Types of Renal Stone):
উপাদানের উপর ভিত্তি করে কিডনির পাথরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়
- ক্যালসিয়াম অক্সালেট স্টোন(Calcium Oxalate Stone):এই ধরনের পাথর সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
- ট্রিপল ফসফেট স্টোন বা স্ট্রুভাইট(Triple Phosphate Stone/Struvite) :এটি তিন ধরনের ফসফেট নিয়ে গঠিত(ক্যালসিয়াম-ম্যাগনেসিয়াম-অ্যামোনিয়াম ফসফেট)।সাধারণত ইনফেকশন হলে এধরনের পাথর হয়।
- ইউরিক অ্যাসিড স্টোন(Uric Acid Stone):অতিরিক্ত মাংস অথবা পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে ইউরিক অ্যাসিড বেশি তৈরি হয় এবং পরবর্তিতে ইউরিক অ্যাসিড স্টোন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।এটি একমাত্র স্টোন যেটিকে এক্সরে করে দেখা যায় না।
- সিস্টিন স্টোন(Cystine Stone):এটি দুর্লভ ধরনের স্টোন।বংশপরম্পরায় হতে পারে ।
কিডনিতে পাথরের রোগ নির্ণয় (The Diagnosis system of kidney stone):
- এক্সরে(X-ray KUB region):এক্সরে করে কিডনি,ইউরেটার ও ব্লাডার দেখা হয়।সাধারণত অধিকাংশ পাথর এক্সরে করলে ধরা পড়ে।ব্যতিক্রম হিসেবে ইউরেট বা ইউরিক অ্যাসিড স্টোন আছে যা এক্সরে করে দেখা যায় না।
- আইভিউ(IVU/Intravenous urogram):এই পদ্ধতিতে রক্তনালীতে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ দেয়া হয় যেটি কিডনি হয়ে মূত্রনালী দিয়ে বাহিরের দিকে আসে।তারপর এক্সরে নেয়া হয়।এখানে ফিলিং ডিফেক্ট দেখা হয়।কিডনি বা মূত্রনালির কোথাও পাথর থাকলে সেটা এর মাধ্যমে বোঝা যায়।
- আল্ট্রাসনোগ্রাম(USG)
- CT scan
কিডনিতে পাথরের চিকিৎসা (Treatment):
পাথরের আকার,অবস্থান ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে এর চিকিৎসা করা হয়ে থাকে ।
- পাথরের আকার .৫ সে.মি. এর কম হলে রোগীকে কিছু পরামর্শ দেয়া হয়।
- বেশি বেশি পানি পান করা
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার কম খাওয়া
- ব্যথা হলে ব্যথানাশক দেয়া
এক্ষেত্রে পাথর প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যেতে পারে
2.পাথরের আকার বড় হলে অপারেশন করার প্রয়োজন হয়।কিছু অপারেশন পদ্ধতি হচ্ছে-
- Percutaneous nephrolithotomy(PCNL):এক্ষেত্রে পিঠের দিকে ছিদ্র করে পুরো স্টোন টিকে বের করে আনা হয়।
- Extracorporeal Shockwave Lithotripsy(ESWL):এক্ষেত্রে বাইরে থেকে shockwave দিয়ে পাথরকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে বের করে আনা হয় ।
তাছাড়া ও কিছু ওপেন পদ্ধতি আছে।যেমন-
- Pyelolithotomy
- Extended pyelolithotomy
- Nephrolithotomy
- partial nephrectomy
কিডনিতে পাথরের প্রতিরোধ (Prevention):
কতগুলো পরামর্শ অনুসরণ করলেই কিডনিতে পাথর হওয়াটাকে প্রতিরোধ করা যায়:
- পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে(দিনে কমপক্ষে ২-৪ লিটার)।
- মূত্রনালীতে কোনো ইনফেকশন হলে চিকিৎসা করতে হবে ।
- খাবারে লবণের পরিমাণ কম রাখতে হবে ।
- বাচ্চাদের লবণ সমৃদ্ধ খাবার যেমন চিপস খাওয়া কমাতে হবে ।
- অতিরিক্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া পরিহার করতে হবে ।
- নিয়মিত ব্যয়ামের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে ।
- পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে ।
- লাল মাংস পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে ।