থ্যালাসেমিয়া কি?
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতা জনিত রোগ।এতে রোগীর দেহে অপর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন অথবা হিমোগ্লোবিনের অস্বাভাবিক গঠন প্রকৃতি তৈরি হয়।রক্তের উপাদান লোহিত রক্ত কণিকার মধ্যে উপস্থিত হিমোগ্লোবিন শরীরে অক্সিজেন বহন করে।এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয় এবং যতটুকু ই তৈরি হয় তা নির্দিষ্ট সময়ের আগে নষ্ট হয়ে যায়।ফলশ্রুতিতে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় যাকে অ্যানিমিয়া বলা হয়।
থ্যালসেমিয়া রোগটি ছোঁয়াচে নয়, এটি ক্যান্সারও নয়।এই রোগটির দুটি অংশ রয়েছে-একটি রক্তস্বল্পতা অন্যটি জন্মগত।রক্তস্বল্পতা বিষয়টি সম্পর্কে ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি এবার জন্মগত বিষয়টি সম্পর্কে জানা যাক।
জন্মগত অর্থে বাবা-মা যে কোনো একজনের বা দুইজনেরই
থ্যালাসেমিয়া থাকতে পারে।সেখান সন্তানের এই রোগটি হওয়ার আশংকা থাকে।মানবদেহে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম বা জিন থাকে।ক্রোমোজম সব সময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে।কারো যখন একটা ক্রোমোজমে ত্রুটি থাকে তাকে বাহক(ক্যারিয়ার স্টেট) বলে।অর্থাৎ তার মধ্যে রোগটির কোনো উপসর্গ দেখা যাবে না।আর দুটি ক্রোমোজমেই ত্রুটি থাকলে ঐ ব্যক্তি রোগটিতে আক্রান্ত(ডিজিজ স্টেট)।তার মধ্যে রোগটির উপসর্গ দেখা যাবে।এক্ষেত্রে বাহকের কারণে পরবর্তী প্রজন্মে থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করার সম্ভাবনা থাকে।
থ্যালাসেমিয়া কয় ধরনের?
দুই ধরনের-
- আলফা থ্যালাসেমিয়া(আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর,আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর).
- বিটা থ্যালাসেমিয়া(বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর,বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর)
আলফা থ্যালাসেমিয়া-
- একটি জিন ত্রুটিযুক্ত থাকলে বাহক হবে, কোনো উপসর্গ দেখা যাবে না।
- দুইটি জিন ত্রুটিযুক্ত হলে-থ্যালাসেমিয়া মাইনর,এক্ষেত্রে সামান্য উপসর্গ দেখ যাবে।
- তিনটি জিন ত্রুটিযুক্ত হলে থ্যালাসেমিয়া এইচ ডিজিজ-এক্ষেত্রে মাঝারি মানের উপসর্গ দেখা যাবে।
- চারটি জিন ত্রুটিযুক্ত হলে মৃত বাচ্চা প্রসব হয়-এটি বিরল।
বিটা থ্যালাসেমিয়া-
- একটি জিন ত্রুটিযুক্ত হলে থ্যালাসেমিয়া মাইনর-মৃদু উপসর্গ দেখা দেয়।
- দুটি জিন ত্রুটিযুক্ত হলে সুস্থ বাচ্চা প্রসব হয়। কিন্তু জন্মের দুই বছর পরেই জটিল লক্ষণাবলী প্রকাশিত হয়।
থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ কি কি?
থ্যালাসেমিয়া রোগে রক্তস্বল্পতা হয় যার কারণে রক্তস্বল্পতা জনিত কিছু লক্ষণ দেখা দেয়
- ক্লান্তি
- দুর্বলতা
- মুখমণ্ডল,চোখ হলুদ বর্ণের বা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
- ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া
- খাওয়ায় অরুচি
- মুখের হাড়ের বিকৃতি দেখা দেওয়া
- ভঙ্গুর হাড়
- শিশুদের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া
- প্রস্রাবের রং গাঢ় হওয়া
- প্লীহার বৃদ্ধির কারণে পেট ফোলা পরিলক্ষিত হওয়া
থ্যালাসেমিয়া রোগ কীভাবে নির্ণয় করা যায়?
থ্যালসেমিয়া রোগ নির্ণয়ের জন্য অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।ডাক্তার সিবিসি(কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট বা সম্পূর্ণ রক্ত গণনা)এবং হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস পরীক্ষার পরামর্শ দেন।সাধারণত স্যাম্পল হিসেবে রক্ত নিয়ে এই পরীক্ষা গুলো করা হয়। সিবিসি করার মাধ্যমে লোহিত রক্ত কণিকার অস্বাভাবিক আকার পরিলক্ষিত হয় আর হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস করার মাধ্যমে কোন ধরনের থ্যালাসেমিয়া সেটা নির্ধারণ করা যায়।
জন্মের পূর্ববর্তী কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা জানা যায়-
- কোরিওনিক ভিলাস নমুনা পরীক্ষা-এটি গর্ভাবস্থার ১১ সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়
- অ্যামনিওসেন্টেসিস(অ্যামনিওটিক তরলের নমুনা পরীক্ষা)-এটি গর্ভাবস্থার ১৬ সপ্তাহে করতে হয়।
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা কি?
হালকা উপসর্গ দেখা দিলে তেমন কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।তবে জটিলতার লক্ষণ দেখা দিলে রক্তের স্থানান্তর অথবা অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে।মাঝারি থেকে গুরুতর সমস্যা দেখা দিলেই চিকিৎসার প্রয়োজন অন্যথায় নয়।চিকিৎসা পদ্ধতি গুলো হল:
- ব্লাড ট্রান্সফিউশন(রক্ত দেয়া):বছরে ৮ থেকে ১২ বার ট্রান্সফিউশন করা লাগতে পারে।সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর পর রক্ত দিলে শরীরের লোহিত রক্ত কণিকা আর হিমোগ্লোবিনের ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ রাখা যায়।রোগের তীব্রতা কম হলে ৪ মাস পর পর রক্ত দিলেও চলবে।
- আয়রন চিলেশন:দীর্ঘদিন রক্ত দেয়ার ফলে রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে আয়রনের বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে তাই রক্ত দেয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত আয়রন অপসারণ করা জরুরি।আয়রন অপসারণের পদ্ধতির নামই আয়রন চিলেশন।তবে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা।
- Splenectomy:বার বার রক্ত সঞ্চালনের কারণে প্লীহা(Spleen)বড় হয়ে যেতে পারে।যাকে মেডিকেলের ভাষায় Splenomegaly বলা হয়।শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে প্লীহা অপসারণ করা হয়ে থাকে যাকে মেডিকেলের ভাষায় Splenectomy বলা হয়।
- পুষ্টি সরবরাহ:ফলিক এসিড ও ভিটামিন বি১২ সমৃদ্ধ খাবার রোগীকে খেতে দিতে হবে।খাদ্য সরবরাহ সম্ভব না হলে ওষুধের মাধ্যমে দিতে হবে।কারণ এই দুটি উপাদান রক্ত কণিকা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।তবে রোগীকে অবশ্যই আয়রন ট্যাবলেট ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে হবে।কারণ আয়রন সমৃদ্ধ খাবার রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।
আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গুলো হলো-ডিমের কুসুম,লাল মাংস,কলিজা,সামুদ্রিকমাছ,ছোলা,ডাল,শিম,মটরশুঁটি,ফুলকপি,পালং শাক, ডার্ক চকলেট।এগুলো খাওয়া যাবে না।
ফলিক এসিড আর ভিটামিন বি১২ সমৃদ্ধ খাবার গুলো হলো-ব্রকলি,কমলালেবু, সবুজ শাকসবজি ও বাদাম জাতীয় খাবার।এগুলো খেতে হবে।
উল্লেখ্য যে,যার যার সাধ্যমতো যতটুকু সম্ভব এগুলো মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে।
- বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট(অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন):এর কাজ হচ্ছে উন্নত রক্ত কোষের তৈরি করা এবং খারাপ কোষগুলোকে সারিয়ে তোলা।এই কাজে সক্ষম দাতার(ডোনার) অস্থিমজ্জা নেওয়া হয় যিনি একই পিতামাতার সন্তান।এই পদ্ধতিটি রক্তের পরিবর্তন আর ওষুধ গ্রহণের ব্যবস্থা কে বাদ দিয়ে অতিরিক্ত আয়রনের সমস্যাটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
-হাড়ের অস্বাভাবিক সমস্যাকে সংশোধনের জন্য অপারেশন করা হয়।
থ্যালাসেমিয়ার জটিলতা গুলো কি কি?
- মুখমণ্ডল ও মাথার খুলির বিকৃতি ঘটতে পারে
- শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত,হার্টে সমস্যা বিশেষত হার্ট ফেইলিউর এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন দেখা দিতে পারে
- প্লীহা অস্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে যেতে পারে
- বার বার রক্ত সঞ্চালনের কারণে অতিরিক্ত আয়রন জমা হয়ে আয়রনের বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে শরীরে অতি সহজেই ইনফেকশন দেখা দিতে পারে।
.
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে করণীয় কি?
প্রতিকার ও প্রতিরোধ বিবেচনায় এই রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সবচেয়ে উপযুক্ত হলো বিবাহের পূর্বেই ছেলে মেয়ে উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়া যে কেউ আক্রান্ত বা দু’জনেই বাহক কিনা।দুজনেই বাহক হলে সন্তান আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।আর ছেলে ও মেয়ের যে কোনো একজন রোগের বাহক হলে পরবর্তী প্রজন্মর সন্তান রোগের বাহক হতে পারে কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
উল্লেখ্য চিকিৎসার মাধ্যমে একজন বাহক তার থ্যালাসেমিয়া বহনকারী জিন প্রতিহত করতে সক্ষম হবেন না।তবে এক্ষেত্রে একজন বাহক সচেতন হয়ে অন্য বাহক কে বিয়ে করা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবেন।
বিয়ের পূর্বে টেস্ট করা না হয়ে থাকলে অবশ্যই সন্তান নেওয়ার পূর্বে করে নিতে হবে।
আর যদি অসুস্থ সন্তান জন্ম নিয়েই থাকে তবে সেক্ষেত্রে জন্মের ২ বছরের মধ্যে নানাবিধ লক্ষণাদি প্রকাশ পায়।তখন অতিদ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
এই রোগের প্রতিকার পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর,জটিল,ব্যয়বহুল।প্রতিরোধই একমাত্র উপযুক্ত উপায়।দুইজন বাহকের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া তথা নতুন সন্তান জন্ম না দেওয়ার মাধ্যমে এই রোগ নির্মূল করা সম্ভব।এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর ৮ই মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস পালিত হয়।
শিশুদের ক্ষেত্রে করণীয় কি?
- নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন ও যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা
- পুষ্টিকর খাবার প্রদান করা
- ইনফেকশন প্রতিরোধে নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করানো
- দীর্ঘ ভ্রমণে অবশ্যই ঘন ঘন পানি পানের ব্যবস্থা রাখা
রক্ত দানের সতর্কীকরণ বার্তা-
- প্রথমত রক্তের গ্রুপ মেলাতে হবে।কোনো অবস্থাতেই অজানা গ্রুপের রক্ত দেয়া যাবে না।এর আগে অবশ্যই ক্রস ম্যাচিং করতে হবে
- রক্তের গ্রুপের মিল খুঁজে না পাওয়া গেলে ‘O’ নেগেটিভ রক্ত দেয়া যেতে পারে।কেননা ‘O’ হচ্ছে সার্বজনীন রক্ত দাতা গ্রুপ।
- অসুস্থ ও ইনফেকশন যেমন হেপাটাইটিস বি,হেপাটাইটিস সি আর HIV আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত নেয়া যাবে না।
- রক্ত অবশ্যই শিরায়(vein)দিতে হবে।
- কোনো অসুবিধা বা খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তৎক্ষনাৎ রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।