বন্ধু রোহান খাবার খেতে খুবই পছন্দ করে। তাও আবার ফাস্টফোর্ড রেস্টুরেন্টের অতিরিক্ত স্পাইসি (spicy ) তৈলাক্ত খাবার। তাই তাই সে একটু মোটাসোটা ধরনের লোক। কিছুদিন আগে সে একবার বলেছিল তার বুকের বা পাশে ব্যথা করে। নামাজ পড়তে যাওয়ার পথে আজ হঠাৎ করেই সে বুকে ব্যথা অনুভব করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আমরা সকলে মিলে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই এবং ডাক্তার আমাদের বন্ধুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বলে বলেন। এখন আসেন এই হার্ট অ্যাটাক বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক:
হার্ট অ্যাটাক কি?
আমরা জানি হার্ট (heart) আমাদের দেহের সমস্ত অঙ্গে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু হার্টের সমস্ত দেহে রক্ত সরবরাহ অর্থাৎ রক্ত পাম্প করতে নিজেরও পুষ্টির বা অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। আর এই অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত হৃদপিণ্ড পেয়ে থাকে দুটি ধমনীর মাধ্যমে:
1। ডান করোনারি ধমনী
2। বাম করোনারি ধমনী
কোন কারনে যদি উক্ত দুই ধমনির মধ্যে ব্লকেজ এর সৃষ্টি হয় তাহলে হৃৎপিণ্ড তার পরিমাণ মতো পর্যাপ্ত অক্সিজেন বা খাদ্য পায় না বা অন্য কোন কারণে যদি করোনারি ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহ কমে যায় তখনই হার্ট এটাকের সৃষ্টি হয়।
কি কারনে করোনারী ধমনীর মধ্যে রক্ত প্রবাহ কম হয়?
করোনারী দমনির মধ্যে ব্লকেজ সৃষ্টি হলে রক্ত প্রবাহ কমে যায়। এছাড়াও বাহ্যিক কোনো কারণে যদি করোনারি ধমনির উপর চাপ বা কম্প্রেশন পরে তখনও রক্ত প্রবাহ কমে যায়। এখন আসি ব্লকের সৃষ্টি হওয়ার কারণ :
- করোনারি দমনির অন্তর্গাত্রে কোলেস্টেরল বা তেলচর্বি জাতীয় খাদ্যের স্তুপ (plaque) জমা হওয়া যাকে মেডিকেলের বাসায় করোনারি অ্যাথেরো স্ক্লেরোসিস বলে।
- মাঝেমধ্যে এই প্লাক ভেঙ্গে গিয়ে রক্তনালীর সরু পদকে ব্লক করে দিতে পারে।
- যেখান থেকে প্লাক রাপচার (rupture ) হয় বা ছিড়ে যায় সেখানে রক্ত এসে জমাট বেঁধে সরু বন্ধ করে দিতে পারে।
হার্ট অ্যাটাক কে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন ও বলা হয়। এটি হলে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তা না হলে রোগীকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ:
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো মানুষ থেকে মানুষে তারতম্য (vary ) করে। যেমন কিছু মানুষের হালকা ব্যাথা থাকে আবার কিছু মানুষের তীব্র ব্যাথা থেকে আবার কিছু মানুষের ক্ষেত্রে কোন ব্যাথাই থাকে না।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ (symptoms):
- বুকে ব্যথা: বুকে চাপ দিয়ে ধরা সুই ফোটালে যেমন ব্যাথা করে তেমন ব্যাথা করতে পারে।
- ব্যাথা বাহু ,গলা অথবা পিঠের দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- শরীর ঘেমে যেতে পারে অথবা ঘাম ঘাম অনুভূত হবে।
- শ্বাস প্রশ্বাস সংক্ষিপ্ত হয়ে আসবে।
- হাঁচি কাশি থাকবে।
- মাথা পাতলা পাতলা মনে হবে।
- বমি বমি ভাব অথবা বমি হতে পারে।
- মহিলাদের ক্ষেত্রে কিছু এটিপিকাল সিমটম দেখা দিতে পারে।
- গলা কাঁধ বা পিঠের দিকে তীক্ষ্ণ ব্যথা।
হার্ট অ্যাটাকের জন্য কারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ:
হার্ট অ্যাটাকের জন্য পুরুষেরাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
Risk factors:
- বয়স : পুরুষদের ক্ষেত্রে সাধারনত ৪৫ বছর বা তার বেশি এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৫৫ বছরের বেশি নারীরা এই রোগের শিকার হয়।
- সিগারেট স্মোকিং : যারা ধূমপান করেন তাদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা অধম পাইপ থেকে অনেক বেশি।
- উচ্চ রক্তচাপ : উচ্চ রক্তচাপের কারণে মাঝেমধ্যে রক্তনালী ছিড়ে গিয়ে সেখানে রক্ত জমাট পেতে গিয়ে রক্ত প্রবাহকে বন্ধ করে দিতে পারে ফলে হার্ট এটাকের সম্ভাবনা উচ্চ রক্তচাপ বিশিষ্ট মানুষের ক্ষেত্রে বেড়ে যায়।
- উচ্চ কলেস্টেরল: আমাদের দেহে দুই ধরনের কোলেস্টেরল আছে :
1। High density lipoprotein:যাকে ভালো লিপিড বলা হয় । কারণ এখানে প্রোটিনের ঘনত্ব বেশি লিপিডের ঘনত্ব কম আর প্রোটিন আমাদের দেহে গঠনে অংশ নেয়।
2। low density lipoprotein যাকে খারাপ লিপিড বলা হয়। আর এখানে প্রোটিন কম লিপিড এর ঘণমাত্রা বেশি আর লিপিড বা তেল চর্বি আমাদের রক্তনালীর অন্তর্গাত্রে জমা হয়ে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়।
- ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিস হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে। তাই কারো ডায়াবেটিস থাকলে তা যত দ্রুত সম্ভব কন্ট্রোলে রাখতে হবে।
- ফ্যামিলি হিস্টোরি: পরিবারের কেউ যেমন বাবা-মা, ভাই বোন যদি আগে থেকেই হার্ট এটাকের রোগী থাকেন তাহলে তাদের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- unhealthy diet: অতিরিক্ত তৈলাক্ত বা মসলাযুক্ত বা চিনি যুক্ত খাবার খাবার খেলেও এ রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে প্রচুর পরিমাণে ফলমূল শাকসবজি বা রাফেজ বা আশ জাতীয় খাবার এ রোগের সম্ভাবনা বহুলাংসে কমিয়ে দেয়।
- sedentary life style: কাজ না করে শুয়ে বসে থাকলেও এ রোগের সম্ভাবনা হওয়ার বেশি।
- স্ট্রেস : অতিরিক্ত আবেগী হওয়া যেমন অনেক বেশি রাত থাকা এ রোগের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।
- illegal drug uses: এ রোগ থেকে বেঁচে থাকতে হলে কুকেন জাতীয় ঔষধ থেকে দূরে থাকতে হবে।
- auto immune diseases: রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস অথবা লোপাস এর মত রোগের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে।
হার্ট অ্যাটাকের জটিলতা:
- অনিয়মিত হৃদপিন্ডের রিদম: হার্টবিট কম হয়ে যাওয়া বা বেশি হয়ে যাওয়া কে হৃদপিন্ডের অনিয়মিত রিদম বলা হয় ।একে মেডিকেলের বাসায় আরিথমিয়া বলে।
হৃদপিন্ড যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দ্রুত চলে বা বেশি হার্ট বিট দেয় তখন তাকে বলা হয় তাকে টাকিকার্ডিয়া ( tachycardia) আর হৃদপিণ্ড যখন স্বভাবিকের চেয়ে কম হার্ট বিট প্রদান করে তখন তাকে ব্রাডিকার্ডিয়া ( bradycardia) বলে।
- cardiogenic shock: যখন হৃদপিণ্ড হঠাৎ করে এবং সম্পূর্ণরূপে ব্লাড পাম্প করতে ব্যর্থ হয় তখন ঘটে।
- Heart failure: হার্টের নিজস্ব muscle এর ক্ষতির কারণে হার্ট অনেক সময় রক্ত পাম করতে ব্যর্থ হয় ফলে শরীরের রক্তের চাহিদা পূরণ হয় না আর ঠিক তখনই হার্ট ফেল হয়।
- pericarditis: হৃদপিন্ডের আবরণীকে পেরিকার্ডিয়াম বলে। অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের কারণে এই পেরিকার্ডিয়ামে ইনফ্লামেশন (inflamation )হইতে পারে বা হয় তখন তাকে pericarditis বলে।
- cardiac arrest: এছাড়াও হার্ট এটাকের জন্য cardiac arrest হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের রোগ নির্ণয়:
হার্ট অ্যাটাক প্রায় ই ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে নির্ণিত হয়। হার্ট অ্যাটাক রোগটি নির্ণয় করতে ব্লাড প্রেসার পালস টেম্পারেচার নজরে রাখতে হবে।
এছাড়াও হার্ট নিয়মিত পাম্প করছে কিনা অথবা হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের চেকআপ করাতে আমরা নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো সর্বদা করে থাকি:
- ECG: হৃদপিন্ডের যেকোনো ধরনের রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমরা সর্বপ্রথম যে পরীক্ষাটি করি সেটি হল ইসিজি। শুধুমাত্র একটি ইসিজি পরীক্ষায় আপনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।
- Blood Test: হার্ট এটাকের সময় কিছু cardiac protien leakage হয়ে রক্তে চলে আসতে পারে। তাই তখন রক্ত পরীক্ষা করে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে হার্ট এটাক সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পাওয়া যায়।
- Chest X ray: চেস্ট এক্সরে পরীক্ষার মাধ্যমে হার্ট ও ফুসফুসের আকার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
- Echocardiogram: এটি শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে হৃদপিন্ডের একটি চলমান চিত্র ধারণ করে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে হৃদপিন্ডের মধ্য দিয়ে কতটুকু ব্লাড চলাচল করছে সেটাও নির্ণয় করা যায়। এই পরীক্ষাটির মাধ্যমে হৃদপিন্ডের কোথায় কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটিও নির্ণয় করা যায়।
- Coronary catheterization ( angiogram)
- Cardiac computed tomography or magnetic resonance imaging (MRI)
- ETT( exercise tolarence test):! এই পরীক্ষাটি ব্যায়াম করা অবস্থায় করানো হয়।
হার্ট অ্যাটাকের প্রতিরোধ জন্য করনীয়:
- একটি সুস্বাস্থ্য জীবনযাত্রা সর্বদা মেনে চলা।
- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, উচ্চকোলেস্টেরল সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- অতিরিক্ত তৈলাক্ত ভাজাপোড়া খাবার না খাওয়া।
- ধূমপান বা মদ খাওয়া এমন জাতীয় নেশা না করা।
- নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলা।
- বেশি পরিমাণে শাকসবজি খাবার খাওয়া।
- সব সময় high stress এ না থেকে রিলাক্স থাকার চেষ্টা করা।
- পরিশেষে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে সহজ সরল জীবন যাপন করার চেষ্টা করা।