অ্যাপেন্ডিসাইটিস কি?
খাদ্য পরিপাক অথবা হজমের সময় যদি এর কিছু অংশ / মলের কিছু কণা সিকাম থেকে অ্যাপেন্ডিক্স চলে যায় তখন এপেনডিক্স ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর কোষের মৃত্যু ঘটে থাকে । ব্যাহত ঘটে তাহলে অ্যাপেন্ডিক্সে প্রদাহ হতে পারে আর একেই বলে এপেন্ডিসাইটিস ।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস হচ্ছে মানুষের তল পেটের জরুরি রোগ।
মানুষের পরিপাকতন্ত্রের একটি অংশ হচ্ছে বৃহদন্ত্র। আর বৃহদন্ত্রের একটি অংশের নাম হচ্ছে সিকাম। সিকামের মধ্যে আঙ্গুলের মত প্রলম্বিত অংশের নাম হচ্ছে অ্যাপেন্ডিস (৪-২০ সে.মি. দৈর্ঘ্যে)।মানুষের দেহের এটি মূলত নিষ্ক্রিয় অঙ্গ , কিন্তু কিছু বিজ্ঞানীর মতে এটি মানুষের খাদ্য পরিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাকটেরিয়া জমা রাখে এবং জন্মের পূর্বে অর্থাৎ মায়ের পেটে শিশুর খাদ্য পরিপাকে এর কিছু ভূমিকা আছে(কিন্তু জন্মের পর তা এখন আর মানুষের প্রয়োজন হয় না
অ্যাপেন্ডিসাইটিসএর দুটি স্টেজ/ধাপ আছে :
- আনকমপ্লিকেটেড: এই স্টেজে উপসর্গ দেখা দেয় এবং এই সময় ডাক্তারের সরণাপন্ন হওয়া উচিত।
- কমলিকেটেড:এই স্টেজে সার্জারি করা অত্যাবশক।
কী কারণে অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়?
অ্যাপেন্ডিসাইটিস সাধারণত (৫০% – ৮০% ক্ষেত্রে) অ্যাপেন্ডিক্স এর গহ্বরের মধ্য মল বা মলদ্বারের পাথরের মত শক্ত কণা, পিত্ত পাথর, টিউমার ,কৃমির (সাধারণত এই প্রজাতির oxyuriasis vermicularis/Enterobius vermicularis ) বিস্তার অথবা গোলকৃমি(Ascaris lumbricoides) মল থেকে অ্যাপেন্ডিক্স এর প্রবেশের কারণে বাধাপ্রাপ্ত হলে হয়।
তাছাড়া অ্যাপেন্ডিক্সের রক্তনালী বাধাপ্রাপ্ত হলে অথবা রক্ত জনিত ইনফেকশনের কারণেও এপেন্ডিসাইটিস হতে পারে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস হওয়া কতটা সাধারন:
২০১৯ সালে, বাংলাদেশে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের হার প্রায় 0.0087% ছিল, যেখানে ঘটনার হার প্রায় 0.2299% ছিল। এই হারগুলি প্রায় ১৯৯০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় ২০.৮% এবং ২০.৫% অতিরিক্ত হয়েছে। 📊🇧🇩
অ্যাপেন্ডিসাইটিস কোথায় বেশি হয়:
অ্যাপেন্ডিসাইটিস মূলত পশ্চিমা বিশ্বের এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারে বেশি হয়ে থাকে কারণ তাদের খাদ্য তালিকায় রাফেজ অথবা আঁশের পরিমান কম থাকে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস কাদের বেশি হয় হয়:
তরুণ বা নতুন প্রাপ্তবয়স্কদের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি (৭%)। সাধারণত বৃদ্ধ বয়সিদের,এ রোগে আক্রান্ত হতে তেমন দেখা যায় না।
তবে অ্যাপেন্ডিসাইটিস সাধারণত মেয়েদের তুলনায় পুরুষদের বেশি হয়ে থাকে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস উপসর্গ কি?
অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর উপসর্গ অত্যন্ত সাধারণ এবং অন্যান্য রোগের উপসর্গের সাথে মিল রাখে। যার কারণে অভিজ্ঞ ডাক্তার এবং উপযুক্ত মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কিন্তু সাধারণভাবে অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগীর যেসব উপসর্গ দেখা যায় তাহলো:
- তলপেটে এক সপ্তাহ ধরে ব্যথা থাকবে এবং ব্যথা আসা যাওয়া করবে।
- বমি বমি ভাব এবং বমি হতে পারে।
- জ্বর।
- তলপেটে ডান দিকে ফোলা অংশের সৃষ্টি হবে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য ( তবে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ডায়রিয়া হয়)।
এসব উপসর্গ সাধারণত আনকমপ্লিকেটেড অ্যাপেন্ডিসাইটিসের রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়,
কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর এসব উপসর্গ না প্রকাশ পেয়ে কমপ্লিকেটেড অ্যাপেন্ডিসাইটিস স্টেজে চলে যায়।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগ কিভাবে নির্ণয় করা যায়?
অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগ নির্ণয়ের জন্য অভিজ্ঞ ডাক্তার এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত কঠিন।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস নিশ্চিত হওয়ার অন্যতম মেডিকেল পরীক্ষা হলো:
- সিটি স্ক্যান
- আল্ট্রাসাউন্ড
তবে প্রাথমিকভাবে যেসব শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে করা যায় তা হলো:
- ব্যাথা না থাকা অবস্থায় ডান দিকে তলপেটে মাঝামাঝি অবস্থায় আঙ্গুল দিয়ে টিপ দিলে ব্যাথা হবে।
- আঙ্গুল দিয়ে টিপ দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পর ব্যথা আরো বেড়ে যাবে।
- তলপেটের বামদিকে হাত দিয়ে সামান্য চাপ দিলে ডান দিকে ব্যথা অনুভূত হবে।
- তলপেটের বামদিকে হাত দিয়ে সামান্য চাপ দিলে ডান দিকে ব্যথা অনুভূত হবে।
- তলপেটের ডানদিকে যে জায়গায় ব্যথা হয় সে জায়গায় টিপ দিয়ে যদি রোগী বামদিকে ঘুরে তাহলেও ব্যথা অন্যদিকে সরে না।
- হাঁটাচলা করলে ব্যথা বেড়ে যায়।
এ সকল পরীক্ষার দ্বারা অ্যাপেন্ডিসাইটিস হওয়ার আশঙ্কা করা যায়।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস জীবন হুমকিমুলক জটিলতা :
কমপ্লিকেটেড অ্যাপেন্ডিসাইটিস কারণে অ্যাপেন্ডিক্সের জায়গায় ছিদ্র হতে পারে যা দ্বারা ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন শরীরের (বিশেষত তলপেটে) ছড়াতে পারে, যার পরিণাম স্বরূপ আরো অনেক জটিল রোগ হতে পারে যেমন পেরিটোনিটাইটিস, সেপিস, সেপিশ সক, যার পরিণতি স্বরূপ মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস চিকিৎসা :
অ্যাপেন্ডিসাইটিস সার্জারি (অ্যাপেনটেক্টমি)ছাড়া আর কোন ওষুধ নেই। অ্যাপেনটেক্টমি সার্জারি খরচও তেমন বেশি না।
আনকমপ্লিকেটেড অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ক্ষেত্রে কিছু এন্টিবায়োটিক দিয়ে সার্জারি পূর্ব প্রস্তুতি এবং সময় বিলম্ব করার সম্ভব। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাময় করতে অ্যাপেনডেক্টমি করা অত্যাবশ্যক।
এখন এই সার্জারি ক্ষেত্রে ল্যাপ্রোস্কোপিক পদ্ধতিও ব্যবহার করা হচ্ছে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
অ্যাপেন্ডিসাইটিস সাধারণত প্রতিরোধ করার কোন উপায় নেই তবে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমানো সম্ভব। যথা:
- খাবারে রাফেজের পরিমাণ বেশি রাখতে হবে যেমন সবুজ শাকসবজি ফলমূল,ভুষি ইত্যাদি।
- মল বেশি সময় ধরে আটকে না রাখা।
- কৃমি এর সমস্যা হলে উপযুক্ত ওষুধ বয়স ভেদে ডোজ অনুযায়ী (albendazole) খাওয়া।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর অন্যান্য তথ্য:
অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর মানুষের জীবনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব:
আনকমপ্লিকেটেড অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগীর অ্যাপেন্ডিক্স সার্জারি (অ্যাপেনডেক্টমি) করার পর রোগী কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু যদি অ্যাপেন্ডিসাইটিস কমপ্লিকেটেড স্টেজে চলে যায় তাহলে জীবন হুমকিমূলক জটিলতা হতে পারে, এমনকি সার্জারি করেও।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস না হয়ে অন্যান্য যে রোগ হতে পারে :
উপসর্গ দেখে অ্যাপেন্ডিসাইটিস হওয়া নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত কঠিন, কারণ একই উপসর্গ বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে দেখা দেয়।
অ্যাপেন্ডিসাইটিসের উপসর্গগুলো অন্যান্য যেসব রোগের সাথে মিল রাখে তা হলো :
- পেটের গ্যাসের সমস্যা।
- লেড বিষাক্ততা।
- একটোপিক গর্ভাবস্থা।
- মেকেল ডাইভার্টিকুলাইটিস।
- মিটেলশমারজ ব্যথা (ডিম্বস্ফোটনের সময় ছোট পেলভিক রক্তপাতের কারণে)।
- মেসেন্টেরিক লিম্ফ্যাডেনাইটিস।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর সারমর্ম:
অ্যাপেন্ডিসাইটিস তলপেটে একটি জরুরি রোগ। যার সময় মত চিকিৎসা না নিলে জীবন ঝুঁকি পর্যন্ত হতে পারে। এ রোগের কোন ওষুধ নেই, কিন্তু সার্জারি মাধ্যমে তা খুব সহজেই নিরাময় করা সম্ভব ।
তাই অ্যাপেন্ডিসাইটিসের উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের সন্নিকটে গিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে হবে।
রেফারেন্স:
- Gray’s Anatomy -42 edition
- (Robbins Pathology) Vinay Kumar MBBS MD FRCPath, Abul K. Abbas MBBS, Jon C. Aster MD PhD – Robbins & Cotran Pathologic Basis of Disease (Robbins Pathology)-Elsevier (2020)
- Harsh Mohan Textbook of Pathology, 7th edition
- Kwathalkar Essentials of Clinical Pathology
- Bailey loves short practice of surgery
- R Rajamahendran – Long Cases in General Surgery, 2nd Edition